মানিকগঞ্জে মঞ্চায়িত হলো নাটক ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’

‘জানো নাকি মানুষ, শ্রাবণ কতখানি শ্রাবণ হলে বত্রিশ নম্বর বাড়িটির সিঁড়ির রক্তচিহ্ন মুছে দেয়া যাবে’ এই সংলাপের মধ্য দিয়ে বত্রিশ নম্বর বাড়িটির যে মানুষটির কথা বলা হলো, সে যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, শ্রাবণের রাতে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিবার পরিজনদের সুপরিকল্পিতভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অজানা সত্য উদঘাটনে গবেষণালব্ধ পাণ্ডুলিপি-মহাপ্রয়াণের শোক আখ্যান ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ নাটকটি মঞ্চায়িত হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের ৪০ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে মানিকগঞ্জ শিল্পকলা মিলনায়তনে ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ নাটকের ৩৭তম মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নাটকটির পরিকল্পনা ও রচনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনন জামান। আর নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশিক রহমান লিয়ন।
নাটকের দৃশ্যপটে দেখা যায়, শ্রাবণ ট্রাজেডির কাহিনী বয়ানে সরাসরি ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট ব্যবহার না করে ইতিহাসের চরিত্র সব ও ঘটনার বর্তমান ব্যাখ্যামূলক প্রতিভঙ্গি রচিত হয়েছে। খুনিদের দাঁড় করানো হয়েছে রঙ্গমঞ্চের কাঠগড়ায়। এই অনুভব ব্যক্ত হয়েছে- প্রাণ হরণ করা যায় চেতনা নয়।
কাহিনীতে দেখা যায়, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ রাত্রির দুপুর বালুঘাট নির্মাণাধীন বিমানবন্দর। তখন শহরটির মাথার উপর একটি কালো রঙের সুগোল চাঁদ ঝুলছিল আর তা থেকে বৃষ্টিবিন্দুর মত ফোঁটা ফোঁটা রাত্রি গড়িয়ে পড়ছিল খুনিদের চোখ আর চিবুকে। প্যারেডের নাম করে তাড়িয়ে আনা অপেক্ষমাণ শতাধিক সেনার মুখোমুখি দাঁড়ায় দীঘল কালো ছায়াগুলো ভয়ঙ্কর জাতি বিনাশী শব্দে খুনি মেজরদের চোয়াল নড়ে উঠে উচ্চারিত হয় ষড়যন্ত্রের সেই অংশটি। তাদের ক্রয়কারী বেনিয়া আর ভাড়াটে এজেন্ট রচনা করে দিয়ে গেছে যাদুময় কথার ইন্দ্রজাল। মিথ্যা ভাষণ যথাযথ আবেগ ব্যবহার করে উচ্চারণ করতে পারলেই হলো বিশ্বাস যোগ্যতার ক্ষেত্র প্রস্তুত। এক মুঠ মার্বেল চালানোর মতো কথাগুলো পূর্বেই ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ষড়যন্ত্র শেষে আরম্ভ হয় খুনিদের অভিযাত্রা। খুনি মেজর আর বিভ্রমে ভরা সেনারা হত্যার হাতিয়ার আর বিকট শকট নিয়ে ছুটে চলেছে ধানমন্ডি অভিমুখে। তাদের লক্ষ্য মানচিত্রের কাঁধে চাপিয়ে দেবে ইতিহাসের সবচেয়ে ভারী লাশের বোঝা। এভাবেই এগিয়ে যায় ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’র গল্প।
নাট্যকার আনন জামান বলেন, ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ নাটকে সত্য বলার জন্য বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ধূসর অতীত থেকে তাড়িয়ে আনা হয়েছে বর্তমানের রঙ্গমঞ্চে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক অভিসন্ধি সিদ্ধির জন্য নয়, ইতিহাস পাঠের জটিল আবর্ত থেকে নিরপেক্ষ সত্য রচনা করার চেষ্টা করেছি।’
‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ প্রসঙ্গে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শাহেদ ইসলাম বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে যান তখন থেকে হত্যাকান্ডের প্রক্রিয়া শুরু। বঙ্গবন্ধু যখন ভারতে যান তখনো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৭৫ সালে এসে কুচক্রী মহলটি সফল হয়। একটি ভূখন্ডে জাতির পিতা হয়ে ওঠার যে দীর্ঘ জার্নি অর্থাৎ ভাষা সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, তিনি মানুষের নেতা কীভাবে হয়ে উঠলেন, কীভাবে জাতির পিতা হয়ে উঠলেন তাও নাটকে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।’
অসাম্প্রদায়িকতার মূর্ত প্রতিক ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে ছিল তার নিবীড় সম্পর্ক। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার ঘটনা উপজীব্য করে তৈরী করা হয়েছে ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ নাটকটি। মহান নেতার হত্যাকারী রাজনৈতিক ও সামরিক বেনিয়া আর খুনিদের মুখোশ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে সতর্ক করা এবং খুনিদের ও তাদের অনুসারীদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করার প্রত্যয় তৈরিতে ভূমিকা রাখবে এই নাটকটি এমন প্রত্যাশা দর্শকদের।
নাটকটিতে অভিনয় করছেন কবির আহামেদ, ফারুক আহমেদ সেন্টু, মো. শাহনেওয়াজ, মনিরুল আলম কাজল, পলি বিশ্বাস, সামিউল জীবন, শিবলী সরকার, শাহরিয়ার হোসেন পলিন, তারেকেশ্বর তারোক, আহাদুজ্জামান কলিন্স, সুমাইয়া তাইয়ুম নিশা, আরাফাত আশরাফ, স্বপ্নিল, কানিজ ফাতেমা লিসা, কাজী তারিফ, রেদোয়ান হোসেন, নূর আকতার মায়া, রিফাত হোসেন জুয়েল, তোফাজ্জল ফয়সাল, রিয়াদ আকাশ, জাহিদ হোসেন অনিক, নাসিম রানা, সোহেল আহমেদ, ইকবাল চৌধুরী ও মীর জাহিদ হাসান।
এসময় উপস্থিত ছিলেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. রমজান আলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সানোয়ারুল হক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুজন সরকারসহ কয়েক শতাধিক দর্শক।