৬০০ বছরের পুরনো মাচাইন শাহী মসজিদ

৩৬০ আওলিয়া নিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলায় আসেন হযরত শাহ জালাল (রহ.)। তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত শাহ্ রুস্তম বোগদাদী (রহ.)। ইসলাম প্রচারের জন্য শাহ্ রুস্তম (রহ.) যখন মানিকগঞ্জের মাচাইন গ্রামে আসেন তার সাথে দেখা করেন তৎকালীন স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্। তার এই ইসলাম প্রচারের কাজ দেখে খুবই আনন্দিত হন তিনি। পরবর্তীতে ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে ওই অঞ্চলে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেন।
জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে হরিরামপুর উপজেলার মাচাইন গ্রামে মসজিদটির অবস্থান। বাংলার স্বাধীন সুলতানী শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ত্রি-গম্বুজ বিশিষ্ট ও আকর্ষণীয় শিল্প মণ্ডিত মাচাইন শাহী মসজিদ। চুন, সুরকি ও সাদা সিমেন্টে নির্মিত এই মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে রয়েছে। মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট, মসজিদের প্রবেশ দ্বার হচ্ছে পূর্ব দিকে আর মিনার পশ্চিমে। উত্তর ও দক্ষিণ পাশের গম্বুজের চেয়ে মাঝের গম্বুজটি একটু বড়। মসজিদটির মূল অংশের ওপর রয়েছে নিখুঁত খাঁজকাটা কারুকাজ। প্রতিটি দেওয়ালেও রয়েছে প্রচুর কারুকাজ, যা যে কারোরই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, শাহ্ রুস্তম যখন মাচাইনে এসেছিলেন ওই সময়টাতে তিস্তার স্রোত ধারা অবলম্বন করে প্রাচীন ভুবনেশ্বর নদী প্রবহমান ছিল। বর্তমানে হরিরামপুর উপজেলার ইছামতি নদীর তীরে এই মাচাইন গ্রামটি অবস্থিত। ওই সময়ে চারদিকে যখন পানি আর পানি তখন শাহ্ রুস্তম (রহ.) বাঁশের একটি মাচা তৈরি করে সেই মাচায় আধ্যাত্মিক চিন্তায় বসতেন। একদিন মাঝ নদীতে ইবাদত করতে দেখে তৎকালীন স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার নৌকার মাঝি-মাল্লাদের যাত্রা বিরতি দিয়ে তার সাথে দেখা করেন। পরে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ ইসলাম প্রচারের জন্য এই অঞ্চলে ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট নান্দনিক শিল্পমণ্ডিত একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদ ও শাহ রুস্তম (রহ.) মাজারটি মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যের প্রতীক ও মুসলিম পুরাকীর্তির দুটি বিশেষ নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শাহ্ রুস্তম (রহ.) যখন এই মাচাইন আসেন তখন এই জনপথটি ছিল পশ্চিম বাংলা ও পশ্চিম ভারতীয় রাজধানীগুলোর মধ্যে জলপথে যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ অঞ্চল। তিনি এই জলপথের ওপর বাঁশের মাচায় বসে ইবাদত করতেন। মাচায় বসে ইবাদত করায় পরবর্তীতে এই গ্রামের নাম রাখা হয় মাচাইন। এ অঞ্চলে শাহ রুস্তম (রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। অলৌকিক গুণের অধিকারী শাহ রুস্তমের (রহ.) কাছে পরে স্থানীয় লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে ঘরবাড়ি স্থাপন করতে শুরু করেন ভক্তরা।
মাচাইন এলাকার বাসিন্দা মো. হানিফ উদ্দিন বলেন, প্রায় ৬০০ বছর আগে এই মাচাইন শাহী মসজিদটি নির্মিত হয় বলে জানা গেছে। বাগদাদ থেকে ৩৬০ আওলীয়ার একটি দল ইসলাম প্রচার করার জন্য আমাদের দেশে আসেন হযরত শাহ জালাল (রহ.) নেতৃত্বে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত শাহ রুস্তম (রহ.)। তিনি আসেন এই মাচাইন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে। আমি আমার পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, তার অলৌকিক গুণে মুদ্ধ হয়ে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করেন। এই মাচাইনে একটি মসজিদ স্থাপন করেন এবং মসজিদকে কেন্দ্র করে মানুষের বসতি গড়ে উঠে।
মাচাইন শাহী মসজিদ কমিটির সহ-সভাপতি মো. বাবুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘মসজিদ ও মাজারটি মানিকগঞ্জ জেলার কালের সাক্ষী হয়ে আছে। অনেক দূরদূরান্ত থেকে মুসুল্লিরা এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে আরো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
মানিকগঞ্জ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক হারেজ সিনহা বলেন, ‘আমাদের এই জেলায় প্রায় ২ হাজার ৪০০ টির বেশি মসজিদ রয়েছে। তবে মাচাইন মসজিদটি দেখতে বিভিন্ন জেলা থেকে লোক আসেন। মসজিদটিতে নিয়মিত নামাজ আদায়ের সব ব্যবস্থা রয়েছে।’