বেদনায় ভরা দিন

তখনও ভোরের আলো ফোটেনি । দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে । এমন সময় প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ । এ গোলাগুলির আওয়াজ ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি ঘিরে , যে বাড়িতে বসবাস করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি , জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । এক বিঘা জমির উপর খুবই সাধারণ মানের ছোট্ট একটা বাড়ি । মধ্যবিত্ত মানুষের মতই সেখানে বসবাস করেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান । তিনি সবসময়ই সাধারণ জীবনযাপন করতেন । এই বাড়ি থেকেই ১৯৭১ সালের ২৬ - এ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন । বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যে আন্দোলন - সংগ্রাম - এই বাড়িটি তার নীরব সাক্ষী । সেই বাড়িটিই হলো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু । গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে আযানের ধ্বনি হারিয়ে যায় । রাষ্ট্রপতির বাসভবনের নিরাপত্তায় সাধারণত সেনাবাহিনীর ইনফেন্ট্রি ডিভিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় । কিন্তু মাত্র ১০-১২ দিন পূর্বে বেঙ্গল ল্যাঞ্চারের অফিসার ও সৈনিকদের এ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । আমার মা , বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব , লক্ষ্য করলেন কালো পোশাকধারী সৈনিকেরা বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত । তিনি প্রশ্নটা তুলেছিলেনও । কিন্তু কোন সদুত্তর পাননি ।
আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছিল দেশের মানুষের প্রতি অঢেল ভালোবাসা । তিনি সকলকেই অন্ধের মত বিশ্বাস করতেন । তিনি কখনও এটা ভাবতেও পারেননি যে , কোন বাঙালি তাঁর ওপর গুলি চালাতে পারে বা তাঁকে হত্যা করতে পারে । তাঁকে বাঙালি কখনও মারবে না , ক্ষতি করবে না - এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি চলতেন । কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো , সেই বিশ্বাসের কি মূল্য তিনি পেয়েছিলেন ?
চারদিকে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ । বিকট শব্দে মেশিনগান হতে গুলি করতে করতে মিলিটারি গাড়ি এসে দাঁড়ালো ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সামনে । গুলির আওয়াজে ততক্ষণে বাড়ির সকলেই জেগে উঠেছে । আমার ভাই শেখ কামাল দ্রুত নিচে নেমে গেল রিসেপশন রুমে - কারা আক্রমণ করলো , কী ঘটনা জানতে । বাবার ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বিভিন্ন জায়গায় ফোন করার চেষ্টা করছিলেন । কিন্তু কোন সাড়া পাচ্ছিলেন না ।
সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কামাল বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখে বাড়ির গেট দিয়ে মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন হুদা এগিয়ে আসছে । কামাল তাদের দেখেই বলতে শুরু করলো : আপনারা এসে গেছেন , দেখেন তো কারা বাড়ি আক্রমণ করলো ?
ওর কথা শেষ হতে পারলো না । তাদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠলো । কামাল সেখানেই লুটিয়ে পড়লো । অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর নূর আর কামাল একইসঙ্গে কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে । আর সেই কারণে ওরা একে অপরকে ভালোভাবে চিনতো । কিন্তু কী দুর্ভাগ্য ! সে চেনা মানুষগুলি কেমন অচেনা ঘাতকের চেহারায় আবির্ভূত হলো । নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করলো সহযোদ্ধা কামালকে । কামাল তো মুক্তিযোদ্ধা । দেরাদুন থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যায় যুদ্ধ করতে । এরপর বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন শেখ কামালকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে ।
মেজর সৈয়দ ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে আমাদের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল । আব্বা সবার আগে ঘর থেকে সেনাবাহিনী প্রধান সফিউল্লাহ সাহেবকে ফোন করেন । তাঁকে জানান বাড়ি আক্রান্ত । তিনি জবাব দেন : আমি দেখছি । আপনি পারলে বাইরে কোথাও চলে যান ।
এর মধ্যে ফোন বেজে ওঠে । কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরিয়াবাত , আমার সেজ ফুফা , ফোনে জানান যে তাঁর বাড়ি কারা যেন আক্রমণ করেছে । আব্বা জবাব দেন তাঁর বাড়িও আক্রান্ত । আব্বা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে ফোন করেন । আব্দুর রাজ্জাক বলেন : লিডার দেখি কী করা যায় । আব্দুর রাজ্জাক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন । তোফায়েল আহমেদ ফোনে বলেন : আমি দেখছি । রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে বলতে থাকেন : আমি কী করবো ? তোফায়েল আহমেদ রক্ষী বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন । আব্বা নিচে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হন । মা পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেন । আব্বা যেতে যেতে - কামাল কোথায় - জিজ্ঞেস করতে থাকেন । কথা বলতে বলতে তিনি সিঁড়ির কাছে পৌঁছান ।
এ সময় সিড়ির মাঝের প্ল্যাটফর্মে যারা দাঁড়িয়েছিল তারাও দোতালায় উঠে আসছিল । এদের মধ্যে হুদাকে চিনতে পারেন আব্বা । আব্বা তার বাবার নাম ধরে বলেন : তুমি রিয়াজের ছেলে না ? কী চাস তোরা ? কথা শেষ করতে না করতেই গর্জে উঠে ওদের হাতের অস্ত্র । তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই যোগ দিয়েছিল রিসালদার মোসলেউদ্দিন ।
ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে সিঁড়ির উপর লুকিয়ে পড়লেন আব্বা । আমার মা সিড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন । ঘাতকের দল ততক্ষণে ওপরে উঠে এসেছে । আমার মাকে তারা বাধা দিল এবং বললো যে আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন । মা বললেন : আমি এক পা - ও নড়বো না , কোথাও যাবো না । তোমরা উনাকে মারলে কেন ? আমাকেও মেরে ফেলো । ঘাতকদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠলো । আমার মা লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে ।
কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল ও জামালের স্ত্রী রোজী জামাল মা’র ঘরে ছিল । সেখানেই তাঁদের গুলি করে হত্যা করে ঘাতকেরা । রাসেলকে রমা জড়িয়ে ধরে এক কোণে দাঁড়িয়েছিল । ছোট্ট রাসেল কিছুই বুঝতে পারছে না । একজন সৈনিক রাসেল আর রমাকে ধরে নিচের তলায় নিয়ে যায় । একইসঙ্গে বাড়িতে আরও যারা ছিল তাদেরও নিচে নিয়ে দাঁড় করায় ।
গৃহকর্মী আব্দুল গুলিবিদ্ধ হয়েছিল । তাকেও নিয়ে যায় । বাড়ির সামনে আম গাছতলায় সকলকে দাঁড় করিয়ে একে একে পরিচয় জিজ্ঞেস করে । আমার একমাত্র চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের পঙ্গু ছিলেন । তিনি বার বার মিনতি করছিলেন : আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ; আমি মুক্তিযোদ্ধা । আমাকে মেরো না । ছোট ছোট বাচ্চারা আমার , ওদের কী হবে ? কিন্তু খুনিরা কোন কথাই কানে নেয় না । তাঁর পরিচয় পেয়ে তাঁকে অফিস ঘরের বাথরুমে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ।
রমার হাত ধরে রাসেল “ মা’র কাছে যাব , মা’র কাছে যাব ” বলে কান্নাকাটি করছিল । রমা বারবার ওকে বোঝাচ্ছিল : তুমি কেঁদো না ভাই । ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে । কিন্তু অবুঝ শিশু মায়ের কাছে যাব বলে কেঁদেই চলছে । এ সময় একজন পরিচয় জানতে চায় । পরিচয় পেয়ে বলে : চলো , তোমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসি ।
ভাইয়ের লাশ , বাবার লাশ মাড়িয়ে রাসেলকে টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে মায়ের লাশের পাশেই গুলি করে হত্যা করে । দশ বছরের ছোট্ট শিশুটাকে ঘাতকের দল বাঁচতে দিল না ।
যে বাড়ি থেকে একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন , সেই বাড়িটি রক্তে ভেসে গেল । সেই রক্তের ধারা ওই সিঁড়ি বেয়ে বাংলার মাটিতে মিশে গেছে- যে মাটির মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন ।
৪৬ ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন সাফায়েত জামিল । সেনাপ্রধান তাঁকে ফোন করে পায়নি । সিজিএস খালেদ মোশাররফও কোন দায়িত্ব পালন করেনি । সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান কোন ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেনি বরং সে পুরো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল । খুনি রশিদ ও ফারুক বিবিসি - তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলেছে । খুনি মোস্তাক জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয় । ঢাকার তৎকালীন এসপি মাহবুবকেও ফোন করে পাওয়া যায়নি ।
মেজ ফুপুর বাসা
ঘাতকেরা ধানমন্ডির মেজ ফুফুর বাড়ি আক্রমণ করে রিসালদার মোসলেউদ্দিনের নেতৃত্বে । তাদের একটি দল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে গালি দিতে থাকে । বুটের আওয়াজ আর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মুক্তিযোদ্ধা যুবনেতা এবং বাংলার বাণীর সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন । বন্দুক তাক করে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে ঘাতকের দল । এ সময় তাঁর অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু ছুটে এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঘাতকদের বুলেট থেকে বাঁচাতে । কিন্তু ঘাতকের দল তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে । বুলেটের আঘাতে দুজনের শরীর ঝাঝরা হয়ে যায় । মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিথর দেহ দুটি । ছোট দুই ছেলে , তিন বছরের তাপস আর বছর পাঁচেকের পরশ , মা - বাবার লাশের পাশে এসে চিৎকার করতে থাকে আর বলতে থাকে : মা ওঠো , বাবা ওঠো । ঐ শিশুদের কান্না মা - বাবা কি শুনতে পেয়েছিল ? ততক্ষণে তাঁরা তো না - ফেরার দেশে চলে গেছে । শিশুদের চোখের পানি মা - বাবার রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায় ।
সেজ ফুপুর বাড়ি
গুলি করতে করতে মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মেজর এ এম রাশেদ চৌধুরী মিন্টু রোডে সেজ ফুফার সরকারি বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে যায় । পরিবারের সকল সদস্যকে তাঁদের ঘর থেকে বের করে নিচতলায় বসার ঘরে নিয়ে আসে । এর পর তাদের উপর ব্রাশ ফায়ার করে । গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন আবার ফুপু আমিনা সেরনিয়াবাত , আমার ফুফা কৃষিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব সেরিয়াবাত , তাঁর মেয়ে বিউটি , বেবি , রিনা , ছেলে খোকন , আরিফ , বড় ছেলে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী শাহানা , নাতি সুকান্ত , ভাইয়ের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ , ভাগ্নে রেন্টু । আট বছরের নাতনি কান্তা গুলিবিদ্ধ লাশের নিচে চাপা পড়ে যাওয়ায় বেঁচে যায় । দেড় বছরের নাতি সাদেক গুলিবিদ্ধ মায়ের বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে । আট বছরের কান্তা নিজের ফুফু বেবির লাশের নিচে চাপা পড়েছিল । সেখান থেকে কোন মতে বের হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে । সারি সারি গুলিবিদ্ধ আপনজন পড়ে আছে । কারও নিথর দেহ , কেউ বা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন । ঘরের কোণায় রাখা অ্যাকুরিয়াম গুলি লেগে ভেঙে যায় । অ্যাকুরিয়ামের পানির সঙ্গে মাছগুলি মাটিতে পড়ে যায় । রক্ত ভেজা পানিতে মাছগুলিও ছটফট করে লাফাতে থাকে । কিছুক্ষণ আগে যে আপনজন মা , বাবা , দাদা - দাদি , চাচা , ফুফুসহ সকলকে নিয়ে এই শিশুরা ছিল , আর এখন গুলিবিদ্ধ রক্তে ভেজা আপনজন । লাশের নিচ থেকে নিজেকে বের করে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে ৮ বছরের শিশুটি অবাক বিস্ময়ে ভীত - সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে ।
মেজর ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে লেকের ওপার থেকে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল । সেই গুলি মোহাম্মদপুরে এক বাড়িতে পড়ে । সেখানে ১১ জন মানুষ নিহত হয় আরও অনেকেই আহত হয় । মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন দখলের দায়িত্বে ছিল । সেখান থেকেই সে ঘোষণা দেয় : শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে । ঘাতকেরা শুধু হত্যা করে তাই নয় , তারা আমাদের বাসা লুটপাট করে । আমার বাবার শোবার ঘরে এবং ড্রেসিং রুমের সকল আলমারি , লকার সবকিছু ভেঙ্গে সেখান থেকে যা কিছু মূল্যবান ছিল - গহনা , ঘড়ি , টাকা - পয়সা লুটপাট করে নিয়ে যায় । বাসায় ব্যবহার করা গাড়িটাও মেজর হুদা ও নূর নিয়ে যায় ।
আলমারীর সব কাপড় চোপড় বিছানার ওপর পড়েছিল । সেগুলোর অনেকগুলোতে ছিল রক্তের দাগ । এই হত্যাকান্ডের পর লুটপাটের ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ওদের চরিত্রের অন্ধকার দিকটা । এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল , তারা এই সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের কত বড় সর্বনাশ করেছিল তা কি ওরা বুঝতে পেরেছিল ?
যে বুকে বাংলার মানুষের জন্য প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিল , সেই বুকটাই ঝাঁঝরা করে দিল তাঁরই প্রিয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু দুর্বৃত্ত । আমার আব্বা কোনদিন বিশ্বাস করতেই পারতেন না যে , বাংলাদেশের কোন মানুষ তাঁকে মারতে পারে , বা কোন ক্ষতি করতে পারে । পৃথিবীর অনেক নেতাই তাঁকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন । কিন্তু তিনি বলেছেন , ওরা তো আমার ছেলে , আমাকে কেন মারবে ? এত বড় বিশ্বাস ভঙ্গ করে ওরা বাঙালির ললাটে কলঙ্ক লেপন করল । কী বিচিত্র এ দেশ ! একদিন যে মানুষটির একটি ডাকে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় এনেছিল , বীরের জাতি হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে মর্যাদা পেয়েছিল , আজ এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সেই জাতি সমগ্র বিশ্বের কাছে বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে পরিচিতি পায় । খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশের অগণিত জনগণ ঘৃণা করে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে । আমার অন্তঃসত্ত্বা চাচী ছয় জন সন্তান নিয়ে চরম বিপদের সম্মুখীন হন । খুলনায় ভাড়ার বাসায় বসবাস করতেন । সে বাসা থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয় । টুঙ্গিপাড়ার বাড়িও সিল করে রাখা হয় । ঘরবাড়ি হারা সদ্য বিধবা কোথায় ঠাঁই পাবেন ?
সোবহানবাগ
আব্বার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হন । সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাঁর গাড়ি আটকে দেয় ঘাতকেরা । তিনি এগুতে চাইলে ঘাতকেরা তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে । আমাদের বাড়ির নিচে পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্য এসআই সিদ্দিকুর রহমানকেও তারা গুলি করে হত্যা করে ।
বেলজিয়াম
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ...। টেলিফোনটা বেজেই যাচ্ছে । আমার ঘুম ভেঙে গেল । মনে হলো টেলিফোনের আওয়াজ এত কর্কশ ? আমি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালাম । দেখি নিচে অ্যাম্বাসেডর সানাউল হক সাহেব ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন । আমাকে দেখে বললেন , ওয়াজেদের সঙ্গে কথা বলবেন । আমি তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম । অপর পারে জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব কথা বলছেন । তিনি জানালেন বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে । আমার মুখ থেকে বের হল : “ তাহলে তো আমাদের আর কেউ বেঁচে নাই ” । রেহানা পাশে ছিল । তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম । কিন্তু তখনও জানি না কী ঘটনা ঘটেছে ।
মাত্র ১৫ দিন আগে জার্মানি এসেছি । বেলজিয়ামে বেড়াতে এসেছি । নেদারল্যান্ডেও গিয়েছিলাম । আব্বা বলেছিলেন , নেদারল্যান্ড কীভাবে সাগর থেকে ভূমি উত্তোলন করে - পারলে একবার দেখে এসো । একদিন আগেই আব্বা - মার সঙ্গে কথা হয়েছে । কেন জানি মা খুব কাঁদছিলেন । বললেন “ তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে , তুই আসলে আমি বলবো । ” আমাদের খুব খারাপ লাগছিল । মনে হচ্ছিল তখনই দেশে ছুটে চলে যাই ।
আব্বা বললেন : রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াতে তিনি যাবেন । আর ফেরার পথে আমাদের নিয়ে আসবেন ।
কিন্তু আমাদের আর দেশে ফেরা হলো না । একদিন পরই সব শেষ । বেলজিয়ামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক , যিনি রাজনৈতিক সদিচ্ছায় অ্যাম্বাসেডর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন , রাতারাতি তার চেহারাটাই পাল্টে গেল । তিনি জার্মানিতে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ সাহেবকে বলেন , যে বিপদ আমার কাঁধে পাঠিয়েছেন তাঁদের ফেরত নেন ।
যিনি আগের রাতে আমাদের জন্য ‘ ক্যান্ডেল লাইট ডিনার ’ এর আয়োজন করেছিলেন ; কত খাতির , আদর - যত্ন , আর এখন আমরা তার কাছে আপদ হয়ে গেলাম । আমাদের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়িটাও দিলেন না । বেলজিয়াম অ্যাম্বাসিতে কর্মরত আমার স্কুলের বান্ধবী নমি’র স্বামী জাহাঙ্গীর সাদাতের গাড়িতে করে আমদের বেলজিয়াম বর্ডারে যেতে বললেন । জাহাঙ্গীর সাদাত আমাদের জার্মানির বর্ডারে পৌঁছে দিলেন । সেখান থেকে পায়ে হেঁটে নোম্যান্স ল্যান্ড পার হয়ে আমরা জার্মানির মাটিতে পৌঁছলাম । জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন । আর তাঁর স্ত্রী আমার বাচ্চাদের জন্য শুকনো খাবার - দাবারও গাড়িতে দিয়েছিলেন । তাঁদের কাছে কয়েকদিন আশ্রয় পেলাম । তাঁদের আদর যত্ন দুঃসময়ে আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান । আমরা কোনদিন ভুলতে পারবো না হুমায়ুন রশীদ ও তাঁর স্ত্রীর অবদান । জার্মান অ্যাম্বাসির সকল অফিসার ও কর্মচারি আমাদের অত্যন্ত যত্ন করেছিলেন । অ্যাম্বাসির গাড়িতে আমাদের কার্লস রুয়ে পৌঁছে দিলেন । জার্মান সরকার , যগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো , ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও অনেকে আমাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চাইলেন । জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের অ্যাম্বাসেডর জনাব হুমায়ুন রশিদ ও ডক্টর ওয়াজেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন । তিনি আমাদের ভারতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন । আমরা জার্মানি থেকে ভারতে পৌঁছালাম ।
উপসংহার
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্টের রক্তাক্ত বেদনার আঘাত বুকে ধারণ করে আমার পথচলা । বাবা মা ভাইদের হারিয়ে ৬ বছর পর ১৯৮১ সালের ১৭ ই মে দেশে ফিরে আসতে পেরেছি । একটি প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি , যে বাংলাদেশ আমার বাবা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন , তা ব্যর্থ হতে পারে না । লাখো শহিদের রক্ত আর আমার বাবা - মা ভাইদের রক্ত ব্যর্থ হতে আমি দেব না ।
আমার চলার পথ খুব সহজ ছিল না , বারবার আমার উপর আঘাত এসেছে । মিথ্যা অপপ্রচার , গুলি , বোমা ও গ্রেনেড হামলার শিকার হতে হয়েছে আমাকে । খুনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময় বলেছিল , “ শত বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না । “ শেখ হাসিনা , প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কখনও হতে পারবে না । ” এর পরেই তো সেই ভয়াবহ ২০০৪ সালের ২১ - এ আগস্টের গ্রেনেড হামলা । আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানবঢাল রচনা করে সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন । উপরে আল্লাহ , আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আর বাংলাদেশের জনগণই আমার শক্তি । আমার চলার কন্টকাকীর্ণ পথে এরাই আমাকে সাহায্য করে চলেছেন । তাই আজকের বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে ।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জনগণের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে । বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি । তারা এখন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে । আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে ।
বাবা ! তুমি যেখানেই থাক না কেন , তোমার আশীর্বাদের হাত আমার মাথার উপর আছে - আমি তা অনুভব করতে পারি । তোমার স্বপ্ন বাংলাদেশের জনগণের অন্ন , বস্ত্র , বাসস্থান , চিকিৎসা , শিক্ষার ব্যবস্থা করে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো । তোমার দেশের মানুষ তোমার গভীর ভালোবাসা পেয়েছে আর এই ভালোবাসার শক্তিই হচ্ছে এগিয়ে যাবার প্রেরণা ।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা ।