নার্স শাহীন-আঞ্জুয়ারা দ্বন্দ্ব চরমে
এসব ঘটনায় উভয় পক্ষকেই উচিত হবে সামাজিক প্রচার নয়, বরং আইনি প্রমাণ ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখা। না হলে নার্সিং পেশার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার পাশাপাশি আইনের চোখে তারা নিজেরাই অভিযুক্ত হয়ে পড়তে পারেন।

বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) সভাপতি শাহিনুর রহমান শাহিন ও নার্স আঞ্জুয়ারা আক্তারকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাটি নার্সিং পেশাজীবীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
আঞ্জুয়ারা ফেসবুক লাইভে এসে শাহিনের বিরুদ্ধে অনৈতিক প্রস্তাব, চাঁদাবাজি ও হয়রানির অভিযোগ আনেন। অন্যদিকে, শাহিনও পাল্টা সংবাদ সম্মেলন ও লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে আঞ্জুয়ারার বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম তুলে ধরেন। ফলে বিষয়টি কেবল দুই ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিরোধেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং এটি এখন একটি আইনি প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে।
অভিযোগের বৈধতা ও প্রমাণের প্রশ্ন
আইনের ভাষায়, কোনো অভিযোগ কেবল তখনই টেকসই হয় যখন তা গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত হয়। আঞ্জুয়ারা প্রথমে তার অভিযোগ ফেসবুক লাইভে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আইন অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার প্রথম ফোরাম হলো তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়।
এদিকে, ফেসবুক লাইভে অভিযোগ করলেও, তা আদালত বা প্রশাসনিক তদন্তে গ্রহণযোগ্য হবে না যদি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ (অডিও, ভিডিও, লিখিত রেকর্ড, সাক্ষ্যপ্রমাণ) না থাকে। অন্যদিকে, শাহিন তার পাল্টা অভিযোগে লিখিত আবেদন দিয়েছেন, যা প্রশাসনিক দৃষ্টিতে একটি সঠিক আইনি পদ্ধতি।
মানহানি ও আইনি দায়
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ ধারা ৫০০ থেকে ৫০২ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির সুনাম ক্ষুণ্ণ করার মতো বক্তব্য প্রকাশ করা হলে তা মানহানির শামিল হতে পারে। যদি প্রমাণ ছাড়া শাহিনের বিরুদ্ধে ফেসবুকে সরাসরি অনৈতিক প্রস্তাব বা চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়ে থাকে, তবে এটি মানহানির অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। একইভাবে, শাহিনের পাল্টা অভিযোগেও যদি অসত্য তথ্য থাকে, তবে আঞ্জুয়ারাও আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন।
প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও চাকরির বিধি
সরকারি হাসপাতালের নার্সরা সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ ও সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ২০১৮ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ কোনো কর্মচারী কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তা অবশ্যই লিখিত আকারে কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করতে হয়। সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ বা বিভাগ পরিবর্তনের অভিযোগও প্রশাসনিক তদন্তে ধরা পড়তে পারে, যা চাকরির শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল। এখানে উভয় পক্ষই একটা সময় পর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন, যা প্রশাসনিকভাবে সঠিক ধাপ।
সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ আনার সাংস্কৃতিক প্রবণতা
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, অনেক সরকারি বা পেশাগত কর্মকর্তা প্রথমে প্রশাসনিক পদক্ষেপ না নিয়ে সরাসরি ফেসবুক লাইভে অভিযোগ আনছেন। একদিকে এটি তাৎক্ষণিক প্রচারের কারণে আলোচনার জন্ম দেয়। কিন্তু অন্যদিকে আইনের দৃষ্টিতে এটি প্রমাণহীন মানহানি, কর্মক্ষেত্রে অশৃঙ্খলা ও পেশাগত শৃঙ্খলাভঙ্গের ঝুঁকি তৈরি করে।
নার্স শাহিন ও নার্স আঞ্জুয়ারার বিরোধ কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি পেশাগত শৃঙ্খলা, মানহানি ও প্রশাসনিক শুদ্ধাচারের প্রশ্নও। এতে করে হাসপাতালের শৃঙ্খলা যেমন বিঘ্ন ঘটেছে তেমনি নিজেদের মধ্যে দলাদলীর সৃষ্টিও হয়েছে। আইন অনুযায়ী, ফেসবুক লাইভে প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে। লিখিত অভিযোগ ও তদন্ত প্রক্রিয়াই হলো সঠিক পথ।
সুতরাং, এসব ঘটনায় উভয় পক্ষকেই উচিত হবে সামাজিক প্রচার নয়, বরং আইনি প্রমাণ ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখা। না হলে নার্সিং পেশার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার পাশাপাশি আইনের চোখে তারা নিজেরাই অভিযুক্ত হয়ে পড়তে পারেন।
লেখক: আসাদ জামান, সাংবাদিক